নাজিমের বাবা নিছার উদ্দিন অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন তিন বছর আগে। তার আগে তিনি অনেক কষ্ট করে এমনকি ভাটায় কাজ করে ছেলেকে মানুষ করেছেন। বাবার পাশাপাশি তার মা মাজেদা বেগমও বাপের বাড়িতে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালিয়েছেন। ছেলেকে ‘মানুষ’ করতে তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ পর্যন্ত করেছেন।
সোমবার কাশিপুর এলাকায় নাজিমের বাড়িতে গিয়ে এসব কথা জানা যায়।
স্থানীয়রা জানান, নাজিম ছোটবেলা থেকে খুব বদ মেজাজি আর একরোখা ছিল। গ্রামে কারও সঙ্গে ভালোভাবে মিশতো না। ২০০৬ সালে মণিরামপুর সরকারি কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। লেখাপড়া শেষ করে এক্সিম ব্যাংকে চাকরি করেন কিছুকাল। পরে ৩৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন তিনি।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের সদ্য সাবেক আরডিসি নাজিমউদ্দীন। ছবি:সংগৃহীত
স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পর থেকে নাজিম এলাকার কাউকে মানেন না। কারণে-অকারণে মানুষকে ভয় দেখান। তার ক্ষমতার ভয়ে সবাই চুপ করে থাকেন। একই কারণে সোমবারও নাজিমের বিরুদ্ধে কথা বলতে গ্রামবাসী ভয় পাচ্ছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা কিছু তথ্য দেন।
স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা দাবি করেছেন, নাজিমের পরিবার আওয়ামী লীগ ভক্ত। তবে সাংবাদিককে নির্যাতন করে নাজিম উদ্দিন অন্যায় করেছেন বলে মন্তব্য করেন গোলাম মোস্তফা।
এদিকে কুড়িগ্রামে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় নাজিমের জড়িত থাকার বিষয়টি জানাজানি হলে মণিরামপুরে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এলাকায় বিষয়টি এখন সবার মুখে মুখে।
নাজিমের অর্থবিত্তের বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে জোরেসোরে। নাজিমের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি শুনে বিরূপ মন্তব্য করছেন এলাকাবাসী। এমনকি নাজিমের মা মাজেদা বেগমও তেমন মন্তব্যই করেছেন।
নাজিম উদ্দিন ২০১৪ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদানের ৩-৪ মাস পর একই উপজেলার হোগলাডাঙা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে সাবিনা সুলতানাকে বিয়ে করেন। আব্দুর রাজ্জাক মণিরামপুর শহরের ভগবানপাড়ায় তার নিজের বাড়িতে থাকেন। আমেরিকা প্রবাসী তার এক ভায়রার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির পাশেই সাড়ে ১৪ লাখ টাকায় কেনা আট শতক জমির ওপরে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশাল চারতলা বাড়ি নির্মাণ করছেন নাজিম উদ্দিন।
এছাড়া কাশিপুরে নানার দেওয়া পাঁচ শতক জমির ওপর তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি একতলা বাড়ি রয়েছে তার। বাড়িটি চারটি সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত। মাত্র ছয় বছরের চাকরিজীবনে কীভাবে তিনি এতো টাকার মালিক হলেন- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এলাকাবাসীর মনে। তারা নাজিম উদ্দিনের সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
নাজিমের নির্মাণাধীন চারতলা বাড়ির ঠিকাদার আতিয়ার রহমান বলেন, ‘২০১৮ সালে হোগলাডাঙা গ্রামের মোসলেম নামে এক লোকের কাছ থেকে সাড়ে ১৪ লাখ টাকায় আট শতক জমি কেনেন নাজিম উদ্দিন ও তার প্রবাসী ভায়রা। সেখানে এক কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যে প্রতি ফ্লোরে তিন ইউনিটের চারতলা একটি বাড়ির কাজ চলছে। প্রতি তলা দুই হাজার ৯০০ বর্গফুটের। ১১ মাস আগে কাজ শুরু হয়েছে। বাড়ির শ্রমিক ঠিকাদার আমি। এই পর্যন্ত ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।’
সোমবার কাশিপুরে নাজিম উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার মা মাজেদা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বউমার কাছে শুনিছি, নাজিমের চাকরির স্থানে কী একটা সমস্যা হয়েছে। বিস্তারিত জানি না।’
পরে সাংবাদিকদের কাছে কুড়িগ্রামে এক সাংবাদিককে নির্যাতনের বিষয়টি শুনে তিনি বলেন, ‘এটা নাজিম ঠিক করিনি। বাড়ি আসলি আমি তাকে বোঝাবো।’
নাজিমের স্ত্রী সাবিনা সুলতানা বলেন, ‘গত রোববার মণিরামপুর বাজারে গিয়ে ঘটনাটি জানতে পারি। নাজিমকে কল করে মোবাইল বন্ধ পাচ্ছিলাম। আজ সকালে নতুন একটা নম্বরে নাজিম কল করেছে। সে বলেছে, একটু ঝামেলা হয়েছে। কোনো সমস্য না। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে।’
নাজিম উদ্দিনের মণিরামপুর বাজারে বাড়ি করার বিষয়ে সাবিনা সুলতানা বলেন, ‘বাড়ির জমিটা আমাদের দুই বোনকে আব্বা দিয়েছেন। সেখানে আমরা দুই বোন মিলে বাড়ি করছি। আমি একটা ব্যাংক লোন নেওয়ার চেষ্টা করছি। এখন খরচ আমার সেই বোন দিচ্ছেন।’
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নানা অনিয়মের রিপোর্ট করায় গত শুক্রবার মধ্যরাতে বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামের বাড়িতে জোর করে ঢুকে তাকে তুলে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন করেন আরডিসি নাজিম উদ্দিনসহ অন্যরা। পরে তাকে মাদক রাখার কথিত অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছরের সাজা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসক, আরডিসিসহ কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।
এর আগে কক্সবাজারে থাকাবস্থায় নাজিমের বিরুদ্ধে এক বৃদ্ধকে মারপিটের অভিযোগ ওঠে। কুড়িগ্রামের ঘটনার পর কক্সবাজারের সেই ভিডিও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল।